তথাকথিত শিক্ষা, প্রযুক্তি, কারিগরি, অর্থনীতিতে আধুনিকতার জয়ধ্বজা ওড়ানো হলেও সমাজ মানসিকতায় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারত নামক দেশটি বহু যুগ পেছনে পড়ে আছে৷ ভারতীয় সমাজে কন্যা সন্তান তথা মেয়েরা এখনো অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবাঞ্ছিত৷ কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্র সরকার কন্যা সন্তানদের কথা মাথায় রেখে নানারকম পরিকল্পনা চালু করেছে, সেই সব পরিকল্পনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাঁচটি সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।
বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও
কন্যাসন্তানের জন্ম সম্পর্কে বহুকাল ধরে চলে আসা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিশেষভাবে সচেষ্ট রয়েছে কেন্দ্রের এনডিএ সরকার।‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ কর্মসূচির সূচনা ২২ জানুয়ারি, ২০১৫ তারিখে হরিয়ানার পানিপথে। এই পরিকল্পনার সূচনা করেছিলেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । কন্যাসন্তানের জন্মহার ক্রমশ হ্রাস পাওয়া এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলির কার্যকর মোকাবিলায় এই কর্মসূচিটির কথা চিন্তাভাবনা করা হয়। প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার প্রসার সহ জনমানসে কন্যাসন্তান সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয় এই কর্মসূচি রূপায়ণের সময়। বিশেষ করে কন্যা ভ্রুণ হত্যা রোধ করার জন্য সরকার থেকে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা। দেশের যেসব জেলায় নারী জনসংখ্যা এর অনুপাতে পুরুষের থেকে কম, প্রাথমিকভাবে সেই সব জায়গায় এই প্রকল্প শুরু করা হলেও পরবর্তী ক্ষেত্রে দেশজুড়ে প্রকল্পটিকে বিস্তার করা হয়।
∆ প্রকল্পটির উদ্দেশ্য:-
•কন্যাসন্তানের বিদ্যালয় যাওয়া সুনিশ্চিত করা।
•লিঙ্গ জনিত কারণে ভ্রূণহত্যা রোধ করা।
•শৈশব অবস্থা থেকেই কন্যাসন্তানের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।
•মেয়েদের সম্পদের অধিকারী বহাল রাখা।
•মেয়েদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা।
বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা
বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চলে, ভারত সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমার (বিপিএল) নীচের পরিবারগুলিতে মেয়েদের বাচ্চাদের অন্তর্ভুক্ত করে, যারা 15 ই আগস্ট, 1997 বা তার পরে জন্মগ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য কন্যা সন্তান ও জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করা। এছাড়াও মেয়েদের বাল্যবিবাহ রোধ ও স্কুলমুখী করা প্রকল্পের উদ্দেশ্য।কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেই জন্মদাত্রী মাকে 500 টাকা দেওয়া হয় এছাড়াও সেই কন্যা সন্তানের পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ এর টাকা দেওয়া হয়।
∆ পড়াশোনার জন্য দেওয়া স্কলারশিপ:-
•প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বছরে 300 টাকা করে এবং চতুর্থ শ্রেণীতে বছরে 500 টাকা দেওয়া হয়ে থাকে।
•পঞ্চম শ্রেণীতে বছরে 600 টাকা এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে বছরের 700 টাকা করে দেওয়া হয়।
•অষ্টম শ্রেণীতে বছরের 800 টাকা এবং নবম ও দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বছরে 1000 টাকা করে দেওয়া হয়।
•কন্যার বয়স 18 বছর পূর্ণ হলে প্রকল্পের সমস্ত টাকা তুলে নেওয়া যায়।
সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা
সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা প্রকল্পটি 2015 সালে পিতামাতাদের তাদের মেয়েদের ভবিষ্যতের সুরক্ষার করার লক্ষ্যে চালু করা হয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রকল্পটি ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পাঠাও’ প্রচারের আওতায় চালু করেছিলেন। এটি একটি ছোট আমানত স্কিম যা কন্যা সন্তানের পড়াশোনা এবং বিবাহ ব্যয় মেটাতে চালু করা হয়েছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী কোন কন্যা সন্তান তার পিতা-মাতা বা আইনি অভিভাবকের সঙ্গে জয়েন্ট একাউন্ট খুলতে পারে। সেই ব্যাংক একাউন্টে প্রথম নাম কন্যা সন্তানের নামে হতে হবে।কন্যা সন্তানের বয়স 10 বছর হওয়ার আগেই ব্যাংক একাউন্ট খুলতে হয় এবং ব্যাংক একাউন্ট খোলার দিন থেকে 15 বছর বা কন্যার বিবাহ পর্যন্ত ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চালু রাখতে হয়। তবে এই প্রকল্পটি সম্পূর্ণ তা লাভ করে একাউন্ট খোলার থেকে 21 তম বছর পর্যন্ত।
∆যোজনা সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:-
•এই স্কিম অনুযায়ী, ব্যাংক একাউন্টে সর্বনিম্ন আড়াইশো টাকা থেকে সর্বোচ্চ দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত রাখা যায়।
•ব্যাঙ্ক অথবা পোস্ট অফিসে অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব।
•প্রকল্পটি শুরু হওয়ার সময় সুদের হার 9.1% থেকে 9.2 % হলেও বর্তমানে এটির সুদের হার 7.6%।
• Income Tax act. 80C ধারা অনুযায়ী এই একাউন্টে দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় পাওয়া যায়।
•একাউন্টধারী কন্যা সন্তানের বয়স 18 বছর পূর্ণ হলে জমা করা আমানতের আংশিক অর্থ উচ্চশিক্ষার জন্য তোলা যেতে পারে।
সিবিএসই উড়ান প্রকল্প
সিবিএসই উড়ান ভারত সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নির্দেশনায় সিবিএসই (কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড) দ্বারা শুরু করা একটি প্রকল্প। দেশের প্রকৌশল কলেজগুলিতে মেয়েদের ভর্তির হার বাড়ানোই এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। এছাড়াও সমাজে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পরা মেয়েদের শিক্ষায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। প্রতি বছর সমাজে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর অন্তর্গত 1000 জন ছাত্রীকে এই গল্পের সুবিধা দেওয়া হয় এবং বাছাই করা ছাত্রীদের প্রথমে একটি করে ট্যাব দেওয়া হয় যেটি তে প্রয়োজনীয় শিক্ষাসংক্রান্ত কন্টেন্ট লোড থাকে।
∆প্রকল্পটি সম্বন্ধে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য:-
•এ প্রকল্প এর জন্য CBSE প্রতি রাজ্যের শিক্ষক ও প্রিন্সিপাল নিয়োগ করে থাকে।
•উচ্চ মেধাসম্পন্ন মেয়েদের বাছাই করে তাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়।
•একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর মেয়েদের বিনামূল্যে অনলাইন পরিষেবা দেওয়া হয় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে।
•পড়াশোনা সংক্রান্ত যে কোন জিজ্ঞাস্য বিষয় থাকলে তার জন্য ফিডব্যাক ও হেল্প লাইন নম্বর রয়েছে।
মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের ইন্সেন্টিভ প্রকল্প
এই প্রকল্প ভারতব্যাপী পরিচালনা করে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক(Ministry of Human Resource Development)। এর স্কুল শিক্ষা ও সাক্ষরতা বিভাগ।অনগ্রসর শ্রেণির মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। প্রধানত 14 থেকে 18 বছরের মেয়েদের যারা অষ্টম শ্রেণি পাস করেছে তাদের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এই প্রকল্পের আওতায় মেয়েরা নিজের নামে 3000 টাকার ফিক্স ডিপোজিট (FD) করতে পারে। এবং এই ফিক্স ডিপোজিট করা অর্থ আঠারো বছর বয়স পূর্ণ হলে সেই মেয়ে সেই সঞ্চিত অর্থ তুলতে পারবে। আংশিক পরিমাণ অর্থ এর আগের সময়সীমার মধ্যে তোলা যাবে না।
∆ প্রকল্পটির সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য:-
•বিবাহিত মেয়েরা এই প্রকল্পের সুবিধা পাবে না।
•অষ্টম শ্রেণী পাস করা সমস্ত তপশিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত মেয়েরা এই প্রকল্পের সুবিধা পাবে।
•তবে অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠী ভুক্ত মেয়েরা যারা কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণী পাস করে তারা এই প্রকল্পের সুবিধা পেতে পারে। তবে তাদের ক্ষেত্রে সরকারি বা সরকার ঘোষিত বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি বাধ্যতামূলক হতে হবে।
•বেসরকারি অথবা কেন্দ্রীয় সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করা মেয়েরা এ প্রকল্পের সুবিধা পাবে না।