2019 সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ চীনের উহান (wuhan) থেকে করোনা (Corona) (COVID 19) নামক ভাইরাসের খোঁজ মেলে। তারপর ধীরে ধীরে গোটা বিশ্ব এই ভাইরাসের কবলে পড়ে। 2020 সালে বিশ্বের প্রতিটি দেশে সংক্রমণ অতি দ্রুত হারে বেড়ে চলছিল। তখন ভারত এই ভাইরাসটির সাথে জোর কদমে লড়াই চালিয়ে ছিল। কিন্তু এই বছর অর্থাৎ 2021 সাল টি হয়ে যায় আরো অভিশপ্ত একটি বছর। ভারতবর্ষে পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ হয়ে ওঠে। তাই আজকে আমরা এই মারণ ভাইরাসের থেকে নিজেকে প্রতিরক্ষা করার জন্য কয়েকটি ব্রহ্মাস্ত্র এর কথা আপনাদের জানাবো। এগুলি আপনি মেনে চললে এই ভাইরাস থেকে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে পারবেন।
করোনা (corona) ভাইরাস প্রতিরোধের প্রথম ধাপ হলো ব্যক্তিগত সচেতনতা গড়ে তোলা এবং প্রত্যেকের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেম বাড়িয়ে তোলা। এর ফলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের যে মারাত্মক লক্ষ্মণ অর্থাৎ শ্বাসযন্ত্র এবং পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণ, সেগুলো সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব। শরীরের ইমিউনিটি শক্তিশালী করে তুলতে আমাদের নিম্নে বর্ণিত খাদ্য গুলি গ্রহণ করতে হবে।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার-
বর্তমান করোনা (corona) পরিস্থিতিতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্থাৎ ইমিউনিটি বাড়ানোর অত্যন্ত জরুরী। সেই ক্ষেত্রে ভিটামিন সি শরীরে অনেক প্রয়োজন।ভিটামিন-সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। তবে ভিটামিন-সি হলো এমন একটি উপাদান যা শরীর তৈরি করতে পারে না। কিন্তু প্রায় সবরকম ফলে ভিটামিন সি যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। আম, আনারস, কমলা লেবু, টমেটো এগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। তাই এইসব ফলগুলি প্রতিদিন খাওয়ার চেষ্টা করুন। এছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন-সি ট্যাবলেট খেতে পারেন।
জিংক সমৃদ্ধ খাবার-
দেহে অনাক্রমতা, প্রোটিন সংশ্লেষণ, এনজাইমেটিক প্রতিক্রিয়া ও বিকাশ বৃদ্ধিতে জিঙ্ক বা দস্তার উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আপনিও দিন ভেজিটেরিয়ান হন তাহলে আপনি সব রকম ডাল, রাজমা, ছোলা, বিন, মটরশুঁটি ইত্যাদি খেতে পারেন। এবং নন ভেজিটেরিয়ান দের ক্ষেত্রে চিংড়ি মাছ, মটন, চিকেন খেতে পারেন। এগুলিতে ভরপুর পরিমাণে জিংক রয়েছে।এছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে জিংক ট্যাবলেট খেতে পারেন।
ডিম-
বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করে চিকিৎসকরা বলছেন প্রতিদিন একটি করে ডিম খেতে। সেদ্ধ ডিমে প্রাকৃতিক ভাবেই প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন আছে। সকাল বেলা জল খাবারে একটি সেদ্ধ ডিম খেলে ৬ গ্রামের বেশি প্রোটিন পাওয়া যায়।
হলুদ মিশ্রিত দুধ পান-
হলুদে থাকে কারকুমিন’ যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে তোলে। এছাড়াও হলুদ ও দুধ একসাথে মিক্স করে খেলে মিশ্রিত দ্রবণের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অনেকাংশে বৃদ্ধি পায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। আপনি দুধের পরিবর্তে জল ব্যবহার করতে পারেন।
আদা চা-
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আদাতে প্রচুর ভিটামিন সি, ম্যাগনেশিয়াম ও অন্যান্য খনিজ থাকে বলে শরীরের জন্য উপকারী। আদা তে রয়েছে জীবাণু-প্রতিরোধী অনেক উপাদান। তাই বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সাথে আদা মিশিয়ে প্রতিদিন নিয়মিত পান করুন।
আমলকি সেবন-
আমলকিতে রয়েছে ক্রোমিয়াম খনিজ, যা দেহের খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। হৃদযন্ত্র হলো আমাদের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। করোনা ভাইরাস হৃদযন্ত্র কেও আক্রান্ত করছে। গবেষণায় দেখা গেছে আমলকি হৃদযন্ত্র কে স্বাস্থ্যকর করে তুলতে সাহায্য। তাই প্রতিদিন আমলকি সেবন করার চেষ্টা করুন।
ভিটামিন ডি গ্রহণ-
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার (corona) মধ্যে যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের জন্য ভিটামিন ডি ভীষণই উপকারী। সাধারণত সূর্যালোকের মাধ্যমে আমাদের ত্বক ভিটামিন ডি প্রস্তুত করে। তাই প্রতিদিন অন্তত নির্দিষ্ট সময় সূর্যালোক গ্রহণ করার চেষ্টা করুন। এছাড়াও আপনি ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন।
চিকেন অথবা ভেজিটেবল সুপ-
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য খেতে পারেন চিকেন বা ভেজিটেবল স্যুপ। কম মসলা দিয়ে তৈরি করুন স্যুপ , এবং গরম গরম পান করুন।
ঘরোয়া কিছু পদ্ধতিতে কিভাবে করোনা ঠেকাবেন সেই সব কিছু খাদ্যতালিকা আপনাদের দেওয়া হল। এবার কয়েকটি স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় উল্লেখ করব যেগুলি ঠিকভাবে আপনি মেনে চললে করোনা কে হারাতে পারবেন।
শ্বাস-প্রশ্বাস সম্পর্কিত যোগব্যায়াম-
করোনা ভাইরাস যেহেতু মানব শরীরের শ্বসনতন্ত্র কে আঘাত করছে সেহেতু আমাদেরকে আমাদের শ্বসনতন্ত্র কে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। আর সেই জন্য আমাদেরকে প্রতিদিন সকালে কিছু যোগ ব্যায়াম অভ্যাস করতে হবে।
মেরুদন্ড টানটান করে বসে মুখ থেকে নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে। এবারে জোরে শ্বাস নিয়ে যতটা সম্ভব বাতাস আপনি ভরে নিতে পারেন তা ফুসফুসে চালান করে দিতে হবে। এবারে কিছুক্ষণ আপনার শ্বাস বন্ধ করে রাখুন। আস্তে আস্তে সেই শ্বাস ত্যাগ করে বের করে দিন।
দিনে দুবার এটা করতে পারলে ভালো ফল পাবেন। এতে আপনার ফুসফুস শক্তিশালী থাকবে। অন্তত ১০ সেকেন্ড শ্বাস ধরে রাখার চেষ্টা করুন। (কপাল ভাতি, অনুলোম বিলোম ইত্যাদি)
গরম জল এ গারগিল-
গরম জলে একটু হলুদ দিয়ে গারগেল করার অনেক উপকারিতা রয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত নানা সমস্যা গরম হলুদ জলে গারগিল করলে সেরে যায়। তাই এই পরিস্থিতিতে গরম জলে গারগিল করুন ও গলা পরিষ্কার রাখুন।
অক্সিমিটার (pulse oximeter)ব্যবহার-
করোনাভাইরাস এর মারাত্মক প্রভাব হিসেবে শরীর অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া একটি লক্ষণ। দেহে অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ঠিক না থাকলে বড় বিপদ ঘটে যেতে পারে। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে আপনি বুঝবেন আপনার শরীরের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কেমন রয়েছে? এই বিষয়টি সঠিকভাবে জানার জন্যই বিজ্ঞানীরা একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন যার নাম হল অক্সিমিটার। এই যন্ত্র ব্যবহার করে আপনি আপনার শরীরের নির্ভুল অক্সিজেন লেভেল জানতে পারবেন। আপনি এই যন্ত্র মেডিকেল স্টোর অথবা অনলাইনেও খুব সহজে কিনতে পারেন।
Pulse Oximeter-এর মাধ্যমে অক্সিজেন লেভেল মাপবেন কীভাবে?
- রোগীর আঙুলে কোনও প্রকার নেল পালিশ অথবা ফলস নেল থাকলে চলবে না।
- পালস অক্সিমিটার ব্যবহারের সময় আঙুল ঘষে হালকা উষ্ণ করে নিন।
- রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপার আগে অন্তত 5 মিনিট বিশ্রাম নিন।
- এর পরে পালস অক্সিমিটার অন করে তর্জনী ঢুকিয়ে দিন।
- শুরুতে রিডিং বদলাতে থাকবে। রিডিং স্থির হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
- সব থেকে বেশি যে সংখ্যাটি অন্তত 5 সেকেন্ড বদলায়নি, সেই সংখ্যাটি লিখে রাখুন।
- প্রত্যেকটি রেকর্ডিংয়ে নজর রাখুন।
- এইভাবে দিনে অন্তত তিন বার রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপতে থাকুন।
ডবল মাস্কিং ও স্যানিটাইজিং-
যে হারে সংক্রমনের মাত্রা বাড়ছে তাতে একটি মাস্ক(mask) এখন আর যথেষ্ট নয়। ট্রেনে বাসে অথবা ভিড় কোন জায়গায় গেলে দুটো মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দুটো মাক্স পড়লে ভাইরাসের ক্ষুদ্র পার্টিক্যাল ঢুকতে বাধা দেবে। কল্যাণের ফর্টিস হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ কীর্তি সাবনিস জানিয়েছেন, দুটো মাস্ক পড়লে covid এর সংক্রমণ 96.4% পর্যন্ত কমাতে পারে। দুটো মাস্ক এর মধ্যে একটি হবে N95 (KN95) মাস্ক অন্যটি সার্জিক্যাল মাস্ক বা কাপড়ের মাস্ক। কোনমতেই যেন দুটি সার্জিক্যাল মাস্ক একসাথে না পরা হয়।
এছাড়াও নিয়মিত হাত স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করুন। পকেট এ সব সময় একই ছোট স্যানিটাইজার রাখার চেষ্টা করুন।
অনেক জায়গায় বলতে দেখা যাচ্ছে যে গরম জলের ভাপ নিলে করোনা (Corona) মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু এই ধারনাটি সম্পুর্ন ভুল। সামান্য নাক বন্ধ হওয়া সংক্রান্ত সমস্যা গরম জলের ভাপ নিলে সারতে পারে তবে এতে করোনার উপর কোন প্রভাব পড়ে না।
* যেগুলি বর্জন করতে হবে।
বিভিন্নফাস্টফুডজাংকফুডবর্জন করতে হবে। সবধরনেরকার্বনেটেডড্রিংকস, বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, তামাক, খয়ের ইত্যাদি। এগুলো রোগপ্রতিরোধক্ষমতায় বাধা দিয়ে ফুসফুসে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়, ঠান্ডা খাবার, আইসক্রিম, চিনি ও চিনির তৈরি খাবার (যা ভাইরাসের সংক্রমণে সহায়তা করে)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন করোনার (Corona) তৃতীয় ঢেউ অতি শীঘ্রই আসতে চলেছে। তাই সকলের অত্যন্ত সচেতন থাকুন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভ্যাকসিন নেওয়ার চেষ্টা করুন, ভ্যাকসিন শরীরের কোন ক্ষতি করে না তাই অন্যের কথায় কান দেবেন না। আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই, তবে অসাবধানতা অবলম্বন করলেই বিপদ। করোনা সম্পর্কিত সরকারের সমস্ত প্রটোকল ও গাইডলাইন গুলি পালন করুন। নিজেকে ও পরিবারকে সুস্থ রাখুন। আত্মীয়-স্বজনদের এই তথ্যগুলি শেয়ার করুন যাতে তারাও এই পরিস্থিতিতে সুস্থ থাকতে পারে।